শরীর ও মনকে সতেজ রাখার একমাত্র উপায় হলো খেলাধুলা। খেলাধুলার মধ্যেই মানুষ খুঁজে পায় এক অন্যরকম আনন্দ। জীবনকে গতিময়, পরিচ্ছন্ন এবং সাবলীলভাবে গড়ে তোলার জন্য খেলাধুলার বিকল্প কিছুতেই নেই। এজন্য শরীর চর্চার জন্য খেলাধুলা অতিব জরুরি। আজকে কথা বলবো হকি খেলার নিয়ম নিয়ে। মাঠের খেলায় জনপ্রিয়তায় তৃতীয় স্থানে আছে হকি। চলুন আর কথা না বাড়িয়ে আজকে আমরা-
হকি খেলার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আসি..
হকি একটি দলগত খেলা। ২টা টিম বানিয়ে খেলতে হয়। একাকী খেলার কোনো সুযোগ নেই। হকি খেলাটা অনেকটা ফুটবল খেলার মতো। অন্যান্য খেলার মতো হকি খেলেতে মাঠ প্রয়োজন হয়। মাঠের দু’প্রান্তে গোলপোস্ট থাকবে। এবং প্রত্যেক দলে ১ জোন গোলকুপার সহ মোট ১১ জন খেলোয়াড় থাকবে। দুই দলে এগারো এগারো মিলিয়ে ২২ জন খেলোয়াড় থাকবে। হকি খেলাটা হাতে থাকা ব্যাট দিয়ে খেলতে হয় এবং গোল করার জন্য গোলপোস্টে বল মারতে হয়। শরীরের কোনো অংশে বল লাগলে তা ফাউল হিসেবে গণ্য হয়। দুই দল তাদের নিজ নিজ জায়গায় প্লেয়ার সাজানোর পরে রেফারি খেলা শুরু করে। হকি খেলা ৭০ মিনিটের খেলা। এই খেলা দুই অর্ধ্বে চলে। অর্থাৎ ৩৫ মিনিট পর কিছু সময় বিরতি হয়ে দুই পক্ষ তাদের পাশ বদলিয়ে আবার নতুন করে ৩৫ মিনিট খেলা চালিয়ে যেতে হয়। তবে দুই অর্ধ্বে খেলার এই নিয়মে খানিকটা পরিবর্তন এসেছে। ২০১৭ সাল থেকে দুই অর্ধ্বের জায়গায় চার অর্ধ্বে খেলা সম্পন্ন হয়।
খেলার সময় গোলপোস্ট ঘেষে বল বাহিরে চলে গেলে কর্নার কিক মারা হয়। সেই সময়ে একজন কর্ণার কিক মারার জন্য থাকে। আরেকজন গোলপোস্ট থেকে মাত্র ১০ গজ দূরে এবং আরেকজন স্ট্রাইকিং সার্কেলে থেকে গোল দেওয়ার চেষ্টা করে। প্রতিপক্ষ থেকে ৫ জন খেলোয়াড় তখন নিজের গোলকিপারকে সহায়তা করতে পারে।
আরো কিছু নিয়ম
গোলকিপার হাত দিয়ে বল ঠেকানো বা ধরতে পারে। তবে ভিন্ন সমস্যায় গোলকিপারের ফাউল হলে সেটা ডিরেক্ট পেনাল্টি হয়ে যায়। আগে ফুটবলের মতো পেনাল্টি মারা হলেও বর্তমানে এই নিয়মে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে পেনাল্টি সিস্টেম হলো- গোলপোস্টের মাত্র ৭ গজ দূর থেকে একজন খেলোয়াড় বল নিয়ে গোলকিপারকে কাটিয়ে তারপর গোল দিতে হয়। একজন খেলোয়াড় তার প্রতিপক্ষের থেকে বল নেওয়া সময়ে প্রথমে মাটিতে একবার বাড়ি দিতে হয়। তারপর প্রতিপক্ষের সামনে থেকে ব্যাটরে সাহায্যে বল কাড়তে হয়। খেলার মধ্যে ঘাড়ের উপরে ব্যাট তুললে ফাউল হবে। এমনকি হাত, পা এবং শরীরের কোনো অংশ দিয়ে বল ঠেকানোর করলে সেটাও ফাউল হিসেবে বিবেচিত হয়। বেশিরভাগ ফাউলের শাস্তি আম্পায়ার ফ্রী কিক দিয়ে সমাধান করেন। মাঠের বাহিরে বল চলে বিভিন্ন রকম নিয়ম আছে৷
কি কি পদ্ধতিতে হকি খেলা হয়
হকি একটি জনপ্রিয় খেলা। তবে আমরা হয়তো খেলার পদ্ধতিগুলো খুব একটা জানিনা! হকি মুলত ৬ পদ্ধতিতে খেলা হয়।
সোজা হিট
শরীরের বাম দিকে বল রেখে হকিস্টিক দিয়ে বলটা গোলপোস্টের দিকে সোজাসুজি মারাকে সোজা হিট বলে।
স্টপিং
নিজের দিকে ছুঁটে আসা বলটাকে থামিয়ে দিয়ে বলটাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করার নাম স্টপিং।
ক্লিক
একটি থেমে থাকা বলকে হকিস্টিক দিয়ে টেনপ নিজের হাঁটু পর্যন্ত উঠিয়ে সজোরে গোলপোস্টের দিকে বলটা মারাকে ক্লিক বলে।
পুশ
বলটিকে সজোরে না মেরে হকিস্টিক দিয়ে আস্তে আস্তে প্রতিপক্ষকে কাটিয়ে বলটা টেনে টেনে সরানোকে পুশ বলে।
ড্রিবলিং
প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে ধোঁকা দিয়ে বলসহ নিজে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াকে ড্রিবলিং বলে।
কূপ
একটা স্থির বলকে সজোরে আঘাত দিয়ে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের মাথার উপর দিয়ে উঁচু করে মারাকে কূপ বলে।
হকি খেলার উৎপত্তি কোন দেশে
ধারণা করা হয় আজ থেকে কয়েকশত বছর আগে গ্রীসে হকি খেলার উৎপত্তি হয়। গ্রিসে হকি খেলা শুরু হলেও তা খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। গ্রিসের এই খেলা দেখে ইংল্যান্ডরা নতুন করে হকি খেলা শুরু করে। নিত্যনতুন নিয়ম এবং বাহারি সব বল, ব্যাট দিয়ে খেলা শুরু করে পুরো বিশ্বের নজরে চলে আসে। এজন্য বলা হয়ে থাকে, গ্রীসে হকি খেলার উৎপত্তি হলেও হকি খেলা পূর্ণতা পেয়েছে মুলত ইংল্যান্ড থেকে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক হকি খেলার মধ্যে যে সব নিয়ম-কানুন রয়েছে তা বেশিরভাগই ইংল্যান্ডের বানানো নিয়ম। ইংল্যান্ড থেকেই আস্তে ধীরে হকি খেলাকে পুরো বিশ্ব চিনতে পারছে। এবং ১৯৪২ সালে হকি খেলার নিয়ন্ত্রক হিসেবে ‘ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল দ্যা হকি’ পুরোপুরিভবে হকি খেলাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নতুন করে শুরু করে।
আন্তর্জাতিকভাবে হকি খেলা
প্রাচীনকাল থেকে শুরু হওয়া খুবই সাদামাটা একটি খেলার নাম হকি। খেলাটা সাদামাটা হলেও খেলার সৌন্দর্য্য সব বয়সি মানুষকে মুগ্ধ করেছে। এই হকি খেলা বিশ্ব দরবারে এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে যে, বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ভারতের জাতীয় খেলা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে হকি খেলা। ভারতের জাতীয় খেলার নাম ‘হকি’। যাকে আমরা হকিস্টিক, ফিল্ড হকি বা শুধু হকি খেলা নামেই চিনে থাকি। বর্তমানে পুরো বিশ্বের মানুষের কাছে হকি খেলা বিপুল জনপ্রিয়তা পেলেও এক সময়ে কেউ এই খেলা চিনতো না! গ্রীসের মানুষজন সাধারণভাবে এই খেলা খেলে বেড়াতো। তাদের দেখাদেখি ইংল্যান্ডরা নতুন করে এই খেলার আবির্ভাব ঘটায় এবং আস্তে আস্তে হকি খেলা বর্তমানে পুরো ওয়ার্ল্ডের মানুষজন খেলে। ক্রিকেট ফুটবলের মতো হকি খেলাও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রয়েছে।
১৯৮৫ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতেই ইংল্যান্ড বনাম আয়ারল্যান্ডের ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে হকি খেলা শুরু হয়। প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে ইংল্যান্ড ৫-০ ব্যাবধানে ম্যাচটি জিতে যায়। পরবর্তীতে ১৯০৮ সালে অলিম্পিক গেইমস এর মতো বড় প্রতিযোগিতায় হকি খেলা অলিম্পিকের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। ১৯৫৮ সালে প্রথম হকি বিশ্বকাপ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। আর এভাবেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হকি খেলা শুরু হয়।
হকি খেলার বলের ওজন
বলের ওজন হবে- ১৫৬ গ্রাম থেকে ১৬৩ গ্রাম পর্যন্ত।
হকি খেলা অনেক প্লেয়ারের সমন্বয়ে খেলা হলেও এর বল খুবই ছোট। লাঠি বা হকিস্টিক এর মাধ্যমে খেলা হয় বলেই বলের সাইজটা একটু ছোট রাখা হয়েছে। হকি খেলার বলের ওজন হবে- ১৫৬ গ্রাম থেকে ১৬৩ গ্রাম পর্যন্ত। এবং সবসময় বলের রঙ সাদা হতে হয়।
হকি খেলার মাঠ
ফুটবল, ক্রিকেট যে খেলাই বলেন না কেন বড়-বড় খেলাগুলো খেলার জন্য বড়সড় মাঠের দরকার হয়। তেমনিভাবে হকি খেলার জন্য আয়তক্ষেত্র মাঠের প্রয়োজন পড়ে। হকি খেলার জন্য ৯১.৪ মিটার (১০০ গজ) লম্বা এবং ৫৫ মিটার (৬০ গজ) চওড়া মাঠ হতে হয়। এবং মাঠের দু’প্রান্তে দুটো গোলপোস্ট দিতে হয়। গোলপোস্ট দু’টো ৭ ফুট (২.১৩ মিটার) উঁচু এবং দুই পিলারের মাঝখানে ৪ গজ মতো দূরত্ব রাখতে হয়। হকি খেলোয়াড়দের প্রায় ৩.২ ফুট (১ মিটার) লম্বা কাঠের লাঠি থাকে।
আন্তর্জাতিকভাবে হকি খেলার প্রতিযোগিতা
ঘরোয়াভাবে হকি খেলার পাশাপাশি বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে বেশ কিছু প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। যেখানে দেশ বিদেশের সব সেরা দলগুলো হকি খেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে। চলুন সে সব প্রতিযোগিতার নামগুলো জেনে আসি..
হকি বিশ্বকাপ পরিসংখ্যান
ফুটবল, ক্রিকেটের মতো হকি বিশ্বকাপ ও অনুষ্ঠিত হয়। কত সাথে কোন দেশ ট্রফিকে উঁচু করে ধরেছে তা হয়তো অনেকেরই অজানা। চলুন স্বল্প পরিসরে হকি বিশ্বকাপ পরিসংখ্যান জেনে আসি..
বিশ্বকাপ হকি চ্যাম্পিয়নশীপ (পুরুষ) পরিসংখ্যান
বছর | বিজয়ী | রানার্সআপ |
১৯৭১ | পাকিস্তান | ভারত |
১৯৭৩ | নেদারল্যান্ডস | ভারত |
১৯৭৫ | ভারত | পাকিস্তান |
১৯৭৮ | পাকিস্তান | নেদারল্যান্ডস |
১৯৮২ | পাকিস্তান | পশ্চিম জার্মানি |
১৯৮৬ | অস্ট্রেলিয়া | ইংল্যান্ড |
১৯৯০ | নেদারল্যান্ডস | পাকিস্তান |
১৯৯৪ | পাকিস্তান | নেদারল্যান্ডস |
১৯৯৮ | নেদারল্যান্ডস | স্পেন |
২০০২ | জার্মানি | অস্ট্রেলিয়া |
২০০৬ | জার্মানি | অস্ট্রেলিয়া |
২০১০ | অস্ট্রেলিয়া | জার্মানি |
২০১৪ | অস্ট্রেলিয়া | নেদারল্যান্ডস |
২০১৮ | বেলজিয়াম | নেদারল্যান্ডস |
২০২৩ | জার্মানি | বেলজিয়াম |
বিশ্বকাপ হকি চ্যাম্পিয়নশীপ (মহিলা) পরিসংখ্যান
বছর | বিজয়ী | রানার্সআপ |
১৯৭৪ | নেদারল্যান্ডস | আর্জেন্টিনা |
১৯৭৬ | পশ্চিম জার্মানি | আর্জেন্টিনা |
১৯৭৮ | নেদারল্যান্ডস | পশ্চিম জার্মানি |
১৯৮১ | পশ্চিম জার্মানি | নেদারল্যান্ডস |
১৯৮৩ | নেদারল্যান্ডস | কানাডা |
১৯৮৬ | নেদারল্যান্ডস | পশ্চিম জার্মানি |
১৯৯০ | নেদারল্যান্ডস | অস্ট্রেলিয়া |
১৯৯৪ | অস্ট্রেলিয়া | আর্জেন্টিনা |
১৯৯৮ | অস্ট্রেলিয়া | নেদারল্যান্ডস |
২০০২ | অস্ট্রেলিয়া | নেদারল্যান্ডস |
২০০৬ | নেদারল্যান্ডস | অস্ট্রেলিয়া |
২০১০ | আর্জেন্টিনা | নেদারল্যান্ডস |
২০১৪ | নেদারল্যান্ডস | অস্ট্রেলিয়া |
২০১৮ | নেদারল্যান্ডস | আয়ারল্যান্ড |
২০২২ | নেদারল্যান্ডস | আর্জেন্টিনা |
ইন্ডিয়া বা ভারতের জাতীয় খেলার নাম হকি।
ভারতের জাতীয় খেলা হকি হলেও ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার নাম ক্রিকেট।
আমাদের সাথে থাকুন।
স্বাধীন স্পোর্টস (Sadhin Sports)